সন্তানের হাতে পরিবার সব নিহত বা নিঃস্ব করে দেয় শুধু প্রেম এবং ভালোবাসার জন্য /সন্তানের হাতে নিহত হওয়ার এ সময়

 

https://www.youtube.com/watch?v=KjAM2xCqRlQ


ছেলে হত্যা করেছে জন্মদাতাকে। পুত্র হত্যা করেছে গর্ভধারিণীকে। আপনজনের কোনো ন্যক্কারজনক বা দুঃখজনক ঘটনা সম্পর্কে মানুষ চরম আক্ষেপে বলে থাকে, ‘এটা দেখার আগেই যেন আমার মৃত্যু হয়।’ ফরিদপুরের ওই বাবা এবং চট্টগ্রামের ওই মায়ের দুর্ভাগ্য এতটাই; যা দেখা সম্ভব নয়, তা দেখেই তাঁরা মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁরা জেনেছেন, আত্মজই তাঁদের ঘাতক। এবং এটা দুঃস্বপ্ন নয়, এটাই বাস্তব। 

ফরিদপুরের বাবা মানুষটাকে তো মৃত্যুর আগে পাঁচ দিন দগ্ধ শরীরের যন্ত্রণা সইতে হয়েছে। আমরা জানি না, এই কয় দিন কোন যন্ত্রণায় বেশি পুড়েছেন তিনি, আগুনে পোড়ার, নাকি সন্তানের পিতৃঘাতী হওয়ার? নাকি মরণযন্ত্রণার চেয়েও বড় হয়ে গিয়েছিল সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়? হয়তো তিনি প্রাণপণে বাঁচতে চেয়েছিলেন, যাতে সন্তান হত্যার দায় থেকে রেহাই পায়!
জীবন সুন্দর, বিচিত্র এবং একই রকম কুৎসিত ও মর্মান্তিক। কিছু সত্য অসহ্য হয়। ছাত্র আন্দোলনের দায়ে কিছুদিন জেলবাস হয়েছিল এই লেখকের। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যে ওয়ার্ডে ছিলাম, সেখানে একদিন এক ছেলেকে আনা হলো। ২০-২২ বছরের ছেলেটির বাড়ি সাভারে। বাবা ছিল না। খুবই গরিব পরিবার। মায়ের সঙ্গে থাকত, দুজনে মিলে পরিবার চালাত। মাকে কুপিয়ে হত্যার দায়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঘটনাটি সে সময় খুব আলোচিত হয়েছিল। প্রায় ছয় ফুট উচ্চতার তাগড়া সুদর্শন ছেলে। কথা বলত না একেবারেই। তাকে জিজ্ঞাসা করার কোনো মানে ছিল না যে আসলে সে-ই হত্যাকারী, নাকি ষড়যন্ত্রের শিকার?
জেলখানার ভেতরে সবাই শক্তের ভক্ত। গরম দেখাতে না পারলে সহবন্দীরা আপনাকে খেতে দেবে না, শুতে দেবে না, বিভিন্নভাবে অত্যাচার করবে। কারণ, হয়তো জায়গা ও বরাদ্দ নিয়ে টানাটানি। সেই অমানবিক পরিবেশে ছেলেটির একদল ভক্ত জুটে গেল। তাকে দেখতাম, সে তাদের জন্য খাবার ছিনিয়ে আনছে লাইন ধরে, রাতে ঠেলে ঠেলে চলাচলের জায়গায় শোয়ার জায়গা বের করছে ভক্তদের জন্য। তাকে দেখে মনে হতো না তার হাত দিয়েই আপন মায়ের হত্যাকাণ্ড সম্ভব হয়েছে। কেউ কেউ সে সময় বলা শুরু করেছিল, সম্পত্তির জন্য মায়ের ভাইয়েরা মাকে হত্যা করে ছেলেকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। বিচারের রায় কার পক্ষে গিয়েছিল, তা-ও জানা নেই।
কিন্তু নতুন মডেলের মোটরসাইকেল কিনে দেওয়া হয়নি বলে যে ছেলেটি বাবা-মায়ের গায়ে আগুন দিয়েছে, তার বিষয়ে সন্দেহ নেই। কাজটা তার দ্বারাই হয়েছে। কিংবা বড় ভাই বকাঝকা করায় চট্টগ্রামের যে ছেলেটি অসুস্থ মাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে, তার ভূমিকাও স্পষ্ট। বাবা-মাকে হত্যার দায়ে ফাঁসির আসামি ঐশীর ঘটনাও সবাই জানেন।
আদালতের কাজ অপরাধে জড়িত ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া। কিন্তু যাদের জন্য একটা নিরাপদ সমাজ দরকার, তাদের ভাবতে হচ্ছে আরও বেশি। কোন পরিস্থিতিতে আদরের সন্তান পিতা-মাতার ঘাতক হয়ে ওঠে? কী তাকে এমন হঠাৎ ক্রোধে বন্য করে তোলে? এরা তো পেশাদার অপরাধী নয়। পেশাদার খুনির নিজেকে ঘৃণা হয় না। খুনের পেছনে খুনির যুক্তিটাও খুনি হয়ে থাকে। যোদ্ধার কাছে যেমন থাকে হত্যার যুক্তি। কিন্তু কেউ যখন প্রিয়তমকে হত্যা করে, তখন সে চলে যায় সব যুক্তির বাইরের এক মনোভাবে। ক্ষণিকের জন্যও যদি হয় এমন মানসিক বিকার, তখন যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। হয়তো ওই রকম মুহূর্তে তাদের যে ‘আমি’, সেই ‘আমি’ ভয়ানক আহত হয়েছিল, হুমকিগ্রস্ত হয়েছিল, তাদের অহং ধাক্কা খেয়েছিল।
ফরিদপুরের পিতৃঘাতী ছেলেটির পুরোনো মডেলের মোটরসাইকেলে আর চলছিল না। তার দরকার হয়েছিল নতুন মডেলের বাইক। হয়তো তার মনে হয়েছিল, নতুন বাইক ছাড়া তার জীবন বৃথা। অল্পবয়সী মনে এমন হতে পারে। ঈদে পাখি মডেলের পোশাক না পাওয়ার তুচ্ছ ঘটনায় কয়েকজন কিশোরীর আত্মহত্যার ঘটনাও আমরা দেখেছি। এই বয়সে মোহ জাগে। সেই মোহের লক্ষ্য কখনো প্রেমিক বা প্রেমিকা, কখনো কোনো ইলেকট্রনিক গেজেট, কখনো গাড়ি বা পোশাক বা এ রকম যেকোনো ভোগ্যবস্তু। ভূতে ধরা লোককে ভূতই চালায় বলে যেমন বিশ্বাস করা হয়; সে তখন তার সুস্থ-স্বাভাবিক ‘আমি’ থাকে না, হয়ে যায় ‘অন্য’ কেউ। তেমনি মোহে অন্ধ মানুষ মোহের বস্তু বা মানুষ সম্পর্কে ভাবে, ‘ওটা বা ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না।’ এটা এক অস্বাভাবিক মনোবিকার; যার হয় সে আর সে থাকে না। এ অবস্থায় কেউ আত্মহত্যা করে, কেউ তার মোহলাভের বাধাকে হত্যা করে। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে প্রেমিকাকে হত্যা করাও প্রায় এমন ধরনেরই আচরণ। এ অবস্থায় প্রিয়তম হয়ে ওঠে তার কাছে ঘৃণ্যতম।
ভোগবাদের সংস্কৃতি যখন মানুষের থেকে ভোগের বস্তুকে, জীবনের থেকে পণ্যকে বড় করে দেখায়, তখন কারও কারও মধ্যে এমন চরম ধ্বংসাত্মক বাসনা জাগতে পারে। কারখানার চেইন-বেল্টের মতো আমরা পণ্যের স্রোতের মধ্যে হিমশিম খাই। সেখানে প্রতিমুহূর্তে পণ্য পিক করতে না পারলে যেন আমি আনফিট। এ অবস্থায় পণ্য ও বস্তুই হয়ে যায় মানুষ ও তার মানবিক অধিকারের বিকল্প। পণ্য ছাড়া তার ‘আমি’ যেন শূন্য হয়ে যায়।
আজকে গণহারে এমন হত্যাকাণ্ড ঘটছে না সত্য। পারিবারিক পরিবেশ, বেড়ে ওঠার প্রভাব ইত্যাদি কারণও রয়েছে এর পেছনে। পাশাপাশি সম্পর্কের ভাঙন, অস্থিরতার প্রভাবও দেখতে হবে। শিশু থেকে তরুণ-তরুণীদের অনেকেই কি এমন ভোগ ও মোহের অসুখে ভুগছে না? মানুষ রেখে টাকা, জিনিস, ভোগ-বিলাসের দিকেই কি ছুটছি না আমরা? বাজার কি সেভাবেই ডাকছে না আমাদের? এর ফেরে পড়ে মানুষের ভেতর থেকে মনুষ্যত্ব ও শান্তি বেলুনের বাতাসের মতো উবে যাচ্ছে। মানুষটা তখন চুপসে যায়, তখনই সম্ভাবনা তৈরি হয় যেকোনো বিপর্যয়ের। ভোগবাদী অসন্তোষ হলো সেই আসল অসুখ। সন্তানের হাতে বাবা-মায়ের হত্যাকাণ্ড হলো সেই রোগের জ্বলন্ত ও রক্তাক্ত লক্ষণ।
আদালত হত্যার বিচার করবেন; কিন্তু সমাজমনস্তত্ত্বকে বিকৃত করার দায়টা তো কাউকে নিতে হবে। শিশুরা মায়ের গর্ভে জন্মালেও, তাদের মন-মানসিকতা গড়ে দেয় সমাজ-বাস্তবতা। সেই বাস্তবতার ওপর পরিবারের হাত নেই, হাত আছে রাষ্ট্রের, সরকারের, ব্যবস্থার। একটা সমাজব্যবস্থা যখন বিগড়ে যায় বা অসুস্থ হয়ে যায়, তখন ‘কোলাটরেল’ বা পারিপার্শ্বিক শিকার হয় অনেক অসাধারণ মানুষ। সমাজের চিকিৎসা না করে ব্যক্তির বিকারের বিহিত করা সম্ভব নয়। আমাদের তরুণেরা কেবল ঝুঁকিতে নেই, তারা নিজেরাই হয়ে উঠছে ঝুঁকি। পিতা-মাতার লাশের সামনে খুনি সন্তানের দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য সেই ঝুঁকির সতর্কঘণ্টা বাজিয়ে গেল।


ন্তানের বিরহে যেমন মাতৃহৃদয় কেঁদে ব্যাকুল হয় তেমনি সন্তানও অকুল হয় মাতৃস্নেহের পিপাসায়। এ দেশের কবি মাতৃভক্তি প্রকাশ করে কবিতা লেখেন, ‘‘মা কথাটি ছোট্ট অতি কিন্তু জেনো ভাই, তাহার চেয়ে নাম যে মধুর ত্রিভুবনে নাই।’’ অথবা ‘‘মাগো, তোর কান্না আমি সইতে পারি না। দোহাই মা আমার লাগি আর কাঁদিস না।’’ ... এসব শুনে আবেগে জড়াতো মা অথবা সন্তানের হৃদয়। মা-বাবা সন্তানের সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল আর সন্তান মা-বাবার সবচেয়ে বড় আকাঙ্খার স্থান।

কিন্তু বর্তমান আধুনিক পরিবারগুলো এখন পরিণত হয়েছে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে। মা-বাবার কাছ থেকে ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছেন সন্তানেরা। এক পরিবারে থেকেও মা-বাবা ও সন্তানেরা দিন কাটাচ্ছেন যে যাঁর মতো করে। পারিবারিক বন্ধন আর আগের মতো দৃঢ় নয়, হয়ে পড়েছে বড়ই ঠুনকো।

সাম্প্রতিক সময়ে গাজীপুর, মৌলভীবাজার ও সিরাজগঞ্জ জেলায় সন্তানের হাতে প্রাণ গেছে তিনজন মায়ের। লাঠির আঘাত ও প্রহার করায় এবং বঁটি দিয়ে গলা কেটে ফেলায় প্রাণ হারান এই মায়েরা। তিন স্থানেই পুলিশ ঘাতক সন্তানদের গ্রেপ্তার করেছে। 

গাজীপুর মহানগরের কোনাবাড়ী থানার দেওলিয়াবাড়ী এলাকায় ছেলে তার বৃদ্ধা মা জোসনা বেগমকে (৭০) বঁটি দিয়ে গলা কেটে হত্যা করেছে। পুলিশ ঘাতক ছেলে শাখাওয়াত হোসেন মাসুমকে (৩০) গ্রেপ্তার করেছে। জোসনা বেগম কাপাসিয়া উপজেলার টোক এলাকার খলিলুর রহমানের স্ত্রী।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কোনাবাড়ী থানার এসআই ফোরকান মোল্লা স্বজনদের বরাত দিয়ে জানান, শাখাওয়াত হোসেন মাসুম মানসিক ভারসাম্যহীন হওয়ায় বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসা করাচ্ছিলেন। জোসনা বেগম কয়েক দিন আগে মাসুমকে নিয়ে দেওলিয়াবাড়ীতে মেয়ে খাদিজার বাসায় আসেন। বুধবার (৮ মার্চ) বেলা ১১টার দিকে খাদিজা তার কাজে বাসা থেকে বের হয়ে যান। কিছুক্ষণ পর মাসুম পাশের ঘরে জোসনা বেগমকে ডেকে এনে বঁটি দিয়ে গলা কেটে ফেলে। এতে মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘটনাস্থলেই জোসনা বেগমের মৃত্যু হয়। আশপাশের লোকজন টের পেয়ে থানায় খবর দেয়।

পুলিশ কর্মকর্তা জানান, মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। এ ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।

এদিকে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে আলীনগর চা বাগানে ছেলের লাঠির আঘাতে মায়ের মৃত্যু হয়েছে। মৃত দেয়ন্তী নুনিয়া (৫১) আলিনগর চা বাগান এলাকার বাসিন্দা। ছেলে সাধন নুনিয়ার (২৩) লাঠির আঘাতে তার মৃত্যু হয় বলে অভিযোগে বলা হয়েছে। দেয়ন্তী নুনিয়া আলীনগর চা-বাগানের বড় লাইনের মৃত জাইয়া নুনিয়ার স্ত্রী। পুলিশ ঘাতক ছেলে সাধনকে আলীনগর চা বাগান থেকে গ্রেপ্তার করে। এ ব্যাপারে কমলগঞ্জ থানায় মামলা হয়েছে।

পরের ঘটনাটি সিরাজগঞ্জের সলঙ্গায়, মাদকাসক্ত ছেলের প্রহারে বিধবা মা চায়না খাতুন (৬০) নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় ছেলে শরিফুল ইসলামকে আটক করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার (৭ মার্চ) রাতে সলঙ্গা থানার নাইমুড়ি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।

সলঙ্গা থানার উপপরিদর্শক মশিউর রহমান জানান, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মহাসড়কে গাড়িচাপায় শরিফুল ইসলামের একটি ছাগলের বাচ্চা মারা যাওয়াকে কেন্দ্র করে মা চায়না খাতুনের সঙ্গে তার কথা-কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে চায়না খাতুনকে প্রহার করে শরিফুল। এতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাড়িতেই তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু রাত ১০টার দিকে তিনি মারা যান। পুলিশ রাতেই শরিফুলকে গ্রেপ্তার করে। মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়েছে। চায়না খাতুনের মেয়ে হাসি খাতুন বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেছেন।

পরিবারের আপন মানুষটির কাছেই আরেকজন সদস্য ক্রমশ নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছে। প্রাণ হারাচ্ছে। সামাজিক অপরাধের লাগামহীন বৃদ্ধিতে মানুষ উদ্বিগ্ন। দেশে এমন নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটছে যা আদিম বর্বরতাকেও হার মানায়। এ নিষ্ঠুরতার ব্যারোমিটার কোথায় গিয়ে ঠেকেছে? আমরা দেখছি সময়ের সাথে বেড়ছে পারিবারিক অস্থিরতা। বেড়েছে নৃশংসতা - বলে জানান বিশিষ্ট অপরাধ বিশেষজ্ঞ শাহেদা বিনতে নূর। 

তিনি আরও বলেন, সন্তানের হাতে বাবা-মা নিহত হওয়ার ঘটনা কি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে না যে, আমরা কোন নষ্ট সমাজ, পঙ্কিল ‘সভ্যতা’র মধ্যে বসবাস করছি আমাদের কি চিন্তা করা উচিত নয় যে, এর থেকে উত্তরণের পথ কী? কোনো শিশু পৃথিবীতে পাপী হয়ে জন্ম নেয় না। জন্ম নেয় ফুলের মতো পবিত্র হয়ে, চাঁদের মতো হাসি আর নির্ঝরের মতো কান্না নিয়ে। তাকে পাপিষ্ঠ করে তার পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র।

সমাজবিজ্ঞানী ড. গাজী সালাহ উদ্দিন বলেন,‘অতিমাত্রায় আধুনিকতার প্রতি আগ্রহী হওয়ায় মানুষের মধ্যে সামাজিক এবং পারিবারিক আদর্শ লোপ পাচ্ছে। ভেঙে যাচ্ছে পারিবারিক বন্ধন। ফলে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা কমছে। আদর্শহীন ও রংচঙে আবহের কারণে ঘটছে নৈতিক অবক্ষয়। এতে করে পিতা-মাতাকে খুন করতে দ্বিধা করছে না সন্তানরা। এ অবস্থা থেকে বের হতে হলে মেনে চলতে হবে সামাজিক অনুশাসন এবং সুদৃঢ় করতে হবে পারিবারিক বন্ধন।’

অতিমাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক এবং বিকৃত মানসিকতার জন্য সন্তানের হাতে পিতা-মাতা খুনের মতো ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আফজাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘নৈতিকতার চরম বিপর্যয়ের ফলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বাড়ছে দূরত্ব। এতে করে তুচ্ছ ঘটনার কারণে প্রিয়জনকে খুন করতে দ্বিধা করছে না সন্তান।’


শাসন করায় বাবার প্রাণটাই কেড়ে নেয় ছোট মেয়ে, জানা গেল সেই রোমহর্ষক ঘটনা

খুলনা নগরীর দৌলতপুরে ব্যবসায়ী শেখ হুমায়ুন কবীরকে হত্যার অভিযোগে থানায় মামলা করেছেন তার স্ত্রী ফারজানা আফরিন। মামলায় থানায় গিয়ে হত্যার ঘটনা স্বীকার করা ছোট মেয়ে (১৬) সহ অজ্ঞাত পরিচয় তিন থেকে চারজনকে আসামি করা হয়েছে। পুলিশ মামলাটি গ্রহণ করে সোমবার (১৫ জুলাই) দুপুরে ওই কিশোরীকে আদালতে পাঠিয়েছে। 

গত ১২ জুলাই বাবার মৃত্যুর ৮ দিন পর খুলনার দৌলতপুর থানায় গিয়ে তার কিশোরী মেয়ে দাবি করেন, ‘আমার বাবাকে আমি ঘুমের ওষুধ খাইয়ে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করেছি, আমাকে গ্রেপ্তার করুন।’ এর আগে গত ৪ জুলাই ভোরে মারা যান নগরীর দৌলতপুর থানার দেয়ানা উত্তপাড়ার বাসিন্দা শেখ হুমায়ুন কবীর।

মামলার এজাহারে নিহতের স্ত্রী অভিযোগ করেন, গত ৩ জুলাই রাত ১০টা থেকে ভোর ৪টার মধ্যে আমার স্বামী মারা যান। তারে হাতে দুটি ছিদ্র ছিল। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অথবা সাপের কামড়ে তিনি মারা গেছেন, এমন ধারণায় স্বাভাবিকভাবেই তার দাফন সম্পন্ন হয়। স্বামীর মৃত্যুর কয়েকদিন পর আমার ছোট মেয়ে আমাকে ও আমার মেঝো মেয়েকে স্বেচ্ছায় জানায়, সে রাতের খাবার ও খাওয়ার পানির মধ্যে ঘুমের ওষুধ মিশিয়েছিল এবং রাতে বালিশ চাপা দিয়ে তার বাবাকে হত্যা করেছে। কারণ জানতে চাইলে সে জানায়, তার বাবা তাকে শাসন করতো বিধায় রাগের বশে তার বাবাকে মেরে ফেলেছে।

স্বামীর মৃত্যুর প্রকৃত রহস্য উদঘাটনের জন্য কবর থেকে মরদেহ উত্তোলন করে ময়নাতদন্তের জন্য মামলার এজাহারে আবেদন জানান তিনি।


স্থানীয়রা জানান, দৌলতপুর থানার দেয়ানার বাসিন্দা শেখ হুমায়ুন কবীরের তিন মেয়ে। বিয়ের পর বড় মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে দেয়ানার বাড়িতে থাকতেন হুমায়ুন কবীর। থানায় আত্মসমর্পণ করা কিশোরী তার ছোট মেয়ে। চলতি বছর এসএসসি পাশ করে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির অপেক্ষায় রয়েছেন তিনি।

দৌলতপুর থানার ওসি প্রবীর কুমার বিশ্বাস জানান, গত ১২ জুলাই রাতে থানায় এসে মেয়েটি হত্যার ঘটনা স্বীকার করে। পরিবারের পক্ষ থেকে এজাহার দেয়ায় তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। তাকে আদালতে পাঠানো হয়েছে।


যেসব মায়েরা নিজ সন্তান হত্যা করেন


নিজেরই গর্ভজাত সন্তানকে হত্যার দায়ে রাশিয়াতে প্রতিবছর বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন কয়েক ডজন মা।

সন্তান হত্যাকারীদের এই তালিকায় অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন গৃহিণী থেকে শুরু করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সফল ব্যবস্থাপকও।

সন্তানকে খুন করবার এই ঘটনা কেবল রাশিয়াতেই ঘটছে না, অ্যামেরিকাতেও প্রতি চার জনের একজন মা নিজের সন্তানকে মেরে ফেলতে চায় বলে জানাচ্ছে মনোবিজ্ঞানীরা।

২০১৪ সালের এক গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, অ্যামেরিকায় গত ৩২ বছরে যত খুন হয়েছে তার মোট ১৫ শতাংশই মূলত মায়ের হাতে শিশু সন্তানের মৃত্যুর ঘটনা।


ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিসের তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৭ সালের মধ্যে ২১ বছরে মোট ১১ হাজার শিশু অভিভাবকদের হাতে নিহত হয়েছে।

গড়ে এই মৃত্যুর সংখ্যা বছরে ৩৪০টিরও বেশি।

কিন্তু রাশিয়ার চিত্রটা যেনো আরো কঠিন।

রাশিয়ায় টিকে থাকতে গেলে অনেক শক্ত ও অনমনীয় মনোভাবের হতে হয়।

ফলে কেউ সেখানে তার মানসিক স্বাস্থ্য সংকট নিয়ে আরেকজনের সাথে সহজে কথা বলতে চায় না।

শিশু হত্যার এই কাহিনীগুলো মূলত দেখাচ্ছে যে, সন্তান জন্ম দেয়ার পরপরই অনেক মা সন্তান জন্মদান পরবর্তী বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়। কিন্তু পরিবারের নিকটজনেরা অনেকক্ষেত্রেই এই বিষণ্নতাকে চিহ্নিত করতে পারেন না। ফলে ঘটে দুঃখজনক পরিণতি।

যত ট্যাবু

মায়েরা কেন তাদের সন্তানদের খুন করেন সেই বিষয়ে রাশিয়ান নারীদের সাথে কথা বলে জানার চেষ্টা করেছেন বিবিসির সাংবাদিক ওলিসা গেরাসিমেঙ্কো ও স্ভেত্লানা রেইটার।

তাদের অনুসন্ধান থেকেই জানা যায়, মাতৃত্বকে যেভাবে মহিমান্বিত করে দেখানো হয় সেই ভাবনায় বদল আনা দরকার।

আলোয়না

আলোয়না পেশায় একজন অর্থনীতিবিদ। পিয়ত্রকে বিয়ে করে সুখী দাম্পত্য কাটানোর সময় সন্তান আগমনের খবরে তারা দু'জনেই খুব উৎফুল্ল ছিল।

জন্মের আগেই শিশুর জন্য পোশাক-আশাক কেনা শুরু করেন তারা। শুধু তাই নয়, মাতৃত্ব ও শিশুর নানা বিষয়ে জানতে যোগ দেন প্রাক-প্রসবকালীন কিছু ক্লাসে।

কিন্তু জন্মদানের পর মায়ের মানসিক সমস্যা কী কী হতে পারে - তা নিয়ে ক্লাসে কেউ কথা বলেনি।

জন্মদানের পর আলোয়না ইনসমনিয়াতে আক্রান্ত হয় এবং সব মিলিয়ে তাল সামলাতে হিমশিম খেতে থাকে।

এই পরিস্থিতিই ধীরে ধীরে মনোরোগ হিসেবে দেখা দেয় এবং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে ওষুধ সেবন শুরু করেন তিনি।

একদিন পিয়ত্র বাড়ি ফিরে দেখে তাদের সাত মাসের শিশুটি পানিতে ডুবে মারা গেছে।

আর আলোয়নাকে পাওয়া যায় মস্কো শহরের সন্নিকটে একটি লেকের ধারে।

পরবর্তীতে জানা যায়, নিজের সন্তানকে পানিতে ডুবিয়ে মারার পর আলোয়না নিজেও ডুবে মরতে গিয়েছিলেন এবং সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকেন।

এখন তার বিচার কার্যক্রম চলছে।

রাশিয়ার অপরাধবিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, নিজের সন্তানকে মেরে ফেলার আগে অন্তত ৮০ ভাগ নারী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন এবং মাথাব্যাথা, ঘুমহীনতা ও অনিয়মিত মাসিকের ব্যপারে পরামর্শ নেন।

এই নারীরা কারা?

রাশিয়ার এটি একটি ট্যাবু। রাশিয়ান আইনে শিশু হত্যার বিষয়টি ট্যাবু-ক্রাইম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

২০১৮ সালে এমন ৩৩টি ঘটনার বিচার চলেছে।

তবে অপরাধবিজ্ঞানীরা বলছেন, যে পরিমাণ ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়ায় বাস্তবে তা ঘটে অন্তত ৮ গুণ বেশি।

ফরেনসিক সাইকিয়াট্রিস্ট মার্গারিটা কাচেভা জানান, নিজের সন্তানকে মেরে ফেলেছে - এমন অন্তত তিন-চারজন প্রতিমাসেই তাদের হাসপাতালে আসে।

বিবিসি যে মায়ের ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখেছে সেখানে হিসাবরক্ষক, শিক্ষক, বেকার নারী, সমাজকল্যাণ বিশেষজ্ঞ, রেস্টুরেন্টের কর্মী থেকে শুরু করে আরো নানা পেশার অন্তত ৩০জন নারী রয়েছে।

অনেক নারী যারা তাদের সন্তানদের খুন করেছে তাদের স্বামী, সংসার, বাড়ি ও চাকরি রয়েছে এবং তারা কোন প্রকার নেশাতেও আসক্ত নয়।

ডাক্তাররা বলেন, সন্তান জন্মদানের পরে, সুপ্ত মনোরোগ সহসাই বেড়ে যেতে পারে।

যে নারী গভীর বিষন্নতায় আক্রান্ত তার দৈনন্দিন কাজে-কর্মে যে এটি সবসময় প্রকাশিত হয় তেমন নয়। কিন্তু গর্ভধারণ, সন্তান জন্মদান ও মেনোপজের ঘটনায় তা হঠাৎই মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে।

আন্না নামের ৩৮ বছর বয়সী স্কুল শিক্ষকেরো রয়েছে এরকম আরেক কাহিনী।

আন্না তার সন্তানকে বালিশ চাপা দিয়ে মারতে চেয়েছিল।

পরে শিশুটিকে কোনমতে উদ্ধার করা হয় আর আন্নাকে পাঠানো হয় হাসপাতালে। সেখানেই ধরা পড়ে যে, আন্না ক্রনিক স্কিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত।


ড. কাচেভা বলেন, মনোরোগে আক্রান্ত হয়ে যে নারী তার সন্তানকে হত্যা করেছে তাকে যে দেখেই পাগল মনে হবে এমন নয়। বরং ঘটনাটি ঘটার আগ পর্যন্ত সে স্বাভাবিক জীবনই কাটাতে পারে।

যেমন ২১ বছর বয়সী আরিনা। নিজের শিশুকে বুকে নিয়ে সে নয়তলা থেকে লাফিয়ে পড়েছিল।

লাফিয়ে পড়ার পরেও অবিশ্বাস্যভাবে তারা দু'জনেই বেঁচে যায়। পুলিশ তাদের উদ্ধার করার পর আরিনাকে হাসপাতালে পাঠানোর হলে তারও স্কিজোফ্রেনিয়া ধরা পড়ে।

অ্যামেরিকার মত রাশিয়াতেও আদালত দোষী মায়েদের নানান ধরণের শাস্তি দিয়ে থাকে। বিশেষত, হত্যাকারী মা যদি পাগল বলে প্রমাণিত না হয় তাহলে তার সাজা হতে পারে দীর্ঘ কারাবাস।

বলা হচ্ছে, যে নারীরা সন্তানদের খুন করছে তারা নিজেরাও নিজেদের শৈশবে কোন না কোন ভাবে নিগৃহীত ছিলেন।

রাশিয়ান এক গবেষণা বলছে, হত্যাকারী মায়েদের মধ্যে অন্তত ৮০ ভাগই দরিদ্র পরিবারে বড় হয়েছেন এবং অন্তত ৮৫ ভাগই বিবাহিত জীবনে দ্বন্দ্ব ও কলহে জড়িত।

গবেষকরা বলছেন, মিথ্য বলা, তর্ক করা, ঝগড়া করা এবং অ্যালকোহলে আসক্তির সাথে পরবর্তীতে শিশু হত্যার সম্পর্ক রয়েছে।

আর নিজের বাবা-মায়ের সাথে যাদের সম্পর্ক জটিলতাপূর্ণ, তারাও পরবর্তীতে শিশুর প্রতি আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে।

হত্যাকারী মায়েদের অধিকাংশই আসলে আবেগীয়, যৌন ও শারীরিকভাবে কোন না কোনভাবে নির্যাতিত।

অবশ্য অনেক আইনজীবী সন্তান হত্যাকারী মায়েদের পক্ষে মামলা নিতে চান না।

৩৩ বছর বয়সী তাতিয়ানা। সে নিজেও ওইসব হন্তারক মায়েদের তিরস্কার করতো। কিন্তু নিজে মা হবার পর তার দুনিয়াটাই একদিন বদলে গেলো।

তার মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা দেখা দিলো এবং সে নিজেও নিজের সন্তানকে মেরে ফেলার কথা ভাবতো। ফলে, এই সংকট থেকে বাঁচতে সে একদিন চিকিৎসকের দ্বারস্থ হয়।

প্রতিরোধ

এই সব হত্যাকাণ্ড বন্ধের অন্যতম উপায় হিসেবে গর্ভধারণ নিরুৎসাহিত করা হয়।

পাশাপশি রাশিয়ান ও পশ্চিমা ডাক্তারেরা মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে, বিশেষ করে, সন্তান জন্মদান পরবর্তী বিষণ্নতা নিয়ে মনোযোগী হবার পরামর্শ দিয়েছেন।

ড. মার্গারিটা কাচায়েভা বলেছেন, রাশিয়ায় নারীদের সংকটকালীর ব্যবস্থার জন্য সেন্টার রয়েছে। কিন্তু সেগুলোও আধ-খালি পড়ে থাকে।

কারণ রাশিয়ান নারীরা মনে করে যে, তার মানসিক সমস্যা নিয়ে কথা বললে হয়তো সন্তানকে তাদের থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হবে।

Post a Comment

0 Comments